সায়ীদ আলমগীর ও রফিক উদ্দিন বাবুল :: কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো নানা আয়োজনে বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে উখিয়ার কুতুপালং ও মধুরছড়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশুদের আঁকা চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা পরিদর্শন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার। বেলা ১২টার দিকে বিশ^ শরণার্থী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত র্যালিতে যোগদান করেন তাঁর নেতৃত্বে আসা টিমটি।
র্যালিটি মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে কুতুপালং রেজি: ক্যাম্পে যাবার পথে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এসময় রোহিঙ্গা ‘আমরা শরণার্থী জীবন চায় না, স্বদেশে ফিরতে চায়’ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করে র্যালিটি আটকে দেয়। এসময় রোহিঙ্গা, দিবস পালন নয়, নাগরিক মর্যাদা নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাসন নিশ্চিতে সহযোগিতা চান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতসহ বিদেশী অতিথিদের কাছে। রাষ্ট্রদূতসহ র্যালীতে অংশগ্রহণকারিরা রোহিঙ্গাদের হাতে প্রদর্শিত প্লে-কার্ড, ব্যানারে লিখিত দাবীগুলো পড়েন।
প্রায় আধা-ঘন্টা পর আইনশৃংখলা বাহিনী সদস্যরা রোহিঙ্গাদের শান্ত করেন। পরে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কুতুপালং রেজি: ক্যাম্পে বৈঠকে বসেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। সেখানেও রোহিঙ্গারা তাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরেন এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাদের আশ^স্ত করেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠকে অংশ নেয়া কুতুপালং রেজি: ক্যাম্পের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি মো. ইউনুচ আরমান বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমাদের বলেছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের আমেরিকার সরকার ৭ বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দিয়েছে এবং আরও অব্যাহত থাকবে।
এর জবাবে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে ইউনুচ বলেন, আমাদের সহযোগিতার দরকার নেই। রোহিঙ্গাদের জন্য দেয়া মার্কিন সহযোগিতা বিভিন্ন এনজিও নানাভাবে খরচ করছে। সব সাহায্য রোহিঙ্গাদের হাতে পৌছাচ্ছে না। এই মুহুর্তে আমাদের দরকার চীন সরকারের মাধ্যমে মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে সম্মানের সাথে স্বদেশে ফেরত পাঠানো। কারণ, বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যাবহুল দেশ। এই দেশে থাকলে যে কোন সময়ে স্থানীয়দের সাথে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আমরা এই দেশে থাকতে আসেনি। বাংলাদেশ সরকার আমাদের জায়গা দেয়ায় আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ। এছাড়াও আমরা বিভিন্ন দাবি দাওয়া উত্থাপন করেছি মার্কিন সরকারের কাছে। তিনি আমাদের আশ^স্ত এবং রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
এসময় ‘ইউএনএইচসিআর’র বাংলাদেশের প্রধান স্টিফেন করলিস, কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম, ক্যাম্প ইনচার্জ রেজাউল করিম, পাবেল হায়দার, ওবাইদুল্লাহসহ সরকারি কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন এনজিও’র প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।
র্যালি শেষে রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্যে ‘ইউএনএইচসিআর’র বাংলাদেশের প্রধান স্টিফেন করলিস বলেছেন, বিশ^ শরণার্থীদের দিবসে আমরা রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে ক্যাম্পে এসেছি। আমরা রোহিঙ্গাদের পাশে আছি এবং থাকব। আমরা মনে করি বাংলাদেশের এই রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বিশে^র ৭ কোটি শরণার্থীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হলো।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম জানিয়েছেন, বিশ^ শরণার্থী দিবস উপলক্ষে মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে এসে রোহিঙ্গা শিশুদের চিত্রাংকণ প্রতিযোগিতা ও র্যালিতে অংশ গ্রহন করেন। এসময় বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে রোহিঙ্গাদের একটিদল স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করে রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। পরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাদের কথা শুনেন। এসময় রোহিঙ্গাদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন এবং তাদের আশ^স্ত করেন। পরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্যাম্প থেকে ফিরে আসেন।
বিশ্ব শরণার্থী দিবস সম্পর্কে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, নিপীড়নের শিকার হয়ে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে শরণার্থী হয়েছি। জীবন ধারণের উপকরণসহ সবদিক দিয়ে সুুুখে থাকলেও মনটা পড়ে আছে রাখাইনে। মাথা উঁচু করে থাকার সুযোগ নিয়ে ফিরে যেতে চায়। আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ সরকারকে আন্তর্জাতিক ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহযোগিতা করে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলে আমাদের ফেরত যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর ২০ জুন এ দিবসটি পালন করা হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৬ কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে রয়েছে। এটি বিশ্বের ইতিহাসে শরণার্থী সংখ্যার সর্বোচ্চ রেকর্ড। মূলত যুদ্ধ, জাতিগত সন্ত্রাসই সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থী সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ।
আর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমণ শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। এরপর থেকে কারণে-অকারণে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে রোহিঙ্গারা। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগসেটর পর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ভয়াবহ আগমন ঘটে। রাখাইনে সহিংস ঘটনায় প্রাণবাঁচাতে পালিয়ে আসে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭জন রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে সব ধরণের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে।
এরপরও, রোহিঙ্গারাদের দাবি শুধু প্রতিবছর শরণার্থী দিবস পালনে অংশীদার হতে চান না। নিজ দেশে ফিরে বাংলাদেশের বোঝা হালকা করতে চান তারা।
উখিয়ার বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্প নেতা কলিম উল্লাহ বলেন, প্রাণ রক্ষায় এসেছিলাম, এবার ফিরে যেতে চাই। সুহযোগিতা যতই পাইনা কেন, শরণার্থী জীবন ভাল লাগে না। গরমে রোহিঙ্গা বস্তিতে থাকলেও মনটা রাখাইনে পড়ে থাকে। আমরা স্বপ্ন দেখি রাখাইনে ফিরে যাবার।
টেকনাফ লেদা ক্যাম্পের দুদুমিয়া ও নয়াপাড়া ক্যাম্পের শফিউল্লাহ, উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নুরুল হাকিম, সেগুপা বেগম, লালু ও ফয়েজ উল্লাহ মাঝিসহ রোহিঙ্গারা বলেছেন, বাংলাদেশ চাইলে হবে না মিয়ানমারকে রাজি হতে হবে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে। আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করলে কেবল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ার পথ খুলতে পারে।
কুতুপালং রেজিষ্ট্রার্ড ক্যাম্পে অবস্থানকারী ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের মংডু থেকে পালিয়ে আসা সাবেক মাঝি হাফেজ আহমদ (৫৫) জানান, মিয়ানমারে থাকাকালে তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। স্বশিক্ষিত এ রোহিঙ্গা নেতা কুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পে আশ্রয়ে আছেন। মিয়ানমারের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রোহিঙ্গা হাফেজ আহমদ মাঝি সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমার সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের কোনোদিন মেনে নেবে না। রোহিঙ্গাদের পক্ষে যারা কথা বলছেন তাদেরও বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, গত ২০১৮ সালের ২১ মার্চ মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট টিন চ’র পদত্যাগ। একইদিনে সংসদের স্পিকার উ উইন মিন্তের স্বেচ্ছায় পদত্যাগের কারণ রোহিঙ্গা ইস্যু।
আরেক রোহিঙ্গা নেতা ডা.ফয়সাল বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে সামান্যতম কথা বলার লোক রয়েছেন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিতে (এনএলডি)। এই দলটির কিছু নেতা আছেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সোচ্চার। সংসদে এনএলডির কর্তৃত্ব থাকলেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। যারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মুখ খুলছেন তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। এ নিয়ে মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠেছে।
কুতুপালংয়ের ৭ নাম্বার ক্যাম্পের হেড মাঝি মুহিদুল্লাহ (৩৫) জানান, রোহিঙ্গারা যেসব গ্রামে বাস করত, সে গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে রাখাইনদের নিয়ে এসে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকার ফিরিয়ে নেবে এ কথা বিশ্বাস করা যায় না।
উখিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছৈয়দ মো. নোমান বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান হওয়া নিয়ে আমরা সন্দিহান। আন্তর্জাতিক কিছু সংগঠন নিজ স্বার্থে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা দেখিয়ে সুুুবিধা আদায় করছে তারা।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যবাসন কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, নানা কারণে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরার বিষয়টি ঝুলে আছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের জয়েন ওয়ার্কিং কমিটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে একাধিক বৈঠকের পরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আলোর মুখ দেখেনি। রোহিঙ্গা ফেরাতে মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো দরকার। এভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা না গেলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন দিনও হবে না।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রাহিঙ্গারা অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশকে একদিন মাশুল দিতে হবে। ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে কক্সবাজারবাসীও চায় কুটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গাদের একটি স্থায়ী সমাধান।
অপরদিকে, টেকনাফে নিবন্ধিত নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষ্যে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে হতে একটি র্যালি বের করা হয়। র্যালিতে ইউএএইচসিআর, এনজিও সংস্থা থাইয়ের কর্মকর্তারা সংহতি প্রকাশ করে অংশনেন। পরে র্যালিটি ক্যাম্প প্রদক্ষিণ শেষে পথসভায় মিলিত হন। ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তা এন্ডরের সভাপতিত্বে পথসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন নয়াপাড়া ক্যাম্প ইনচার্জ আব্দুল হোছাইন।
থাইয়ের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ইমরান খানের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন এনজিও ফোরামের শিশির দাশ, অধরার আনোয়ার, থাইয়ের মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন,এসিএফের এনামুল হক, রোহিঙ্গাদের পক্ষ হতে খালেদা বেগম, আবু ছিদ্দিক, আনসার উল্লাহ প্রমুখ।
পাঠকের মতামত: